আসক্তদের ১০% স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী

শাহিদ মোস্তফা শাহিদ, কক্সবাজার সদর :

মিয়ানমারে তৈরি মরণ নেশা ইয়াবা এখন কক্সবাজার সদর উপজেলার বৃহত্তর ঈদগাঁও এলাকার চিহ্নিত কিছু স্থান থেকে পাচার হচ্ছে নিয়মিত। এসমস্ত ইয়াবা পাচার নিয়ন্ত্রণ ২০-২৫ সদস্যের সিন্ডিকেটের হাতে। মায়ানমার সীমান্তবর্তী উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমসহ গভীর বনজঙ্গল ঘেরা অরক্ষিত বিভিন্ন চোরা পথ দিয়ে গর্জনিয়া-বাইশারী ও সন্ত্রাস কবলিত ঈদগড় সড়ক হয়ে এবং কক্সবাজার শহর থেকে একমাত্র যানজট ও পুলিশ টহলমুক্ত খুরুষ্কুল-চৌফলদন্ডী সড়ক ব্যবহার করে হাজার হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট ঈদগাঁও ইয়াবা সিন্ডিকেটের হাতে এসে পৌছে। এক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সিন্ডিকেট সদস্যরা নানা কৌশল অবলম্বন ও সুযোগ বুঝে গভীর রাতে ঈদগাঁও বাসস্টেশন গরু বাজার সংলগ্ন জাগির পাড়া রোড, সওদাগর পাড়া, দরগাহ গেইট পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের আশপাশ এলাকা, ইসলামাবাদ শাহ ফকির বাজার, জাহানারা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বাশঘাটা, ইসলামপুর বটতলী স্টেশন, গজালিয়া বাবুল ফকিরের আস্তানা, ঈদগড় বড়বিল সড়ক, চৌফলদন্ডী, নতুন মহাল, পোকখালী দক্ষিণ নাইক্ষ্যংদিয়া। এসব স্থানগুলো পরিণত হয়েছে ইয়াবা পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসলামাবাদের খোদাইবাড়ী গ্রামের ইয়াবা ও মাদক সেবনকারী ব্যক্তি বলেন, এসমস্ত স্পট থেকে সে এবং তার সহপাঠিরা সহজে ইয়াবা সংগ্রহ করে থাকে। আরেক সূত্র জানায়, বিগত এক বছরে এসব স্থান থেকে ৩শ, ৪শ, ৫শ করে অসংখ্য চালান বাহিরে পাচার হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে পুলিশ ইয়াবা পাচারকারীদের আটক করে মামলার মাধ্যমে তাদেরকে জেল হাজতে প্রেরণ করলেও পরবর্তীতে তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যায়। তারপর কোন হদিস মিলেনা। সূত্র জানায়, আটককৃতরা স্বল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে জেল হাজত থেকে বেরিয়ে পড়ে আবারো ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়ে। বাস্তবতা হচ্ছে মাঝে মধ্যে চুনোপুটি পাচারকারীরা ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায় মূল হোতারা। ঈদগাঁও কেন্দ্রীক ইয়াবা সিন্ডিকেট রাজনৈতিক নাম ব্যবহার করে এ ব্যবসা চালাচ্ছে। আবার অনেক সময় ছাত্র রাজনীতির আড়ালেও ইয়াবা পাচার হচ্ছে বলে অনেকের অভিযোগ। চোরাই পথগুলো দিয়ে প্রথমে সিন্ডিকেটের হাতে আসে। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। ২০-২৫ সদস্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এ ইয়াবা সিন্ডিকেট তাদের পছন্দমত এ ৯ স্থান থেকে তাদের সুবিধামত সময় সুযোগে ইয়াবা পাচার করে থাকে। বিশেষ করে ইসলামাবাদ হরিপুরের শামসুল আলম ও তার স্ত্রী রেহেনা বেগম প্রকাশ রানু মাদক বেচাকেনায় শীর্ষে রয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। তাদের বিষয়ে উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক সভায় একাধিকবার অবহিত করার পরও কোন ব্যবস্থা নেননি বলে জানান একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ ব্যাপারে কক্সবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রনজিত কুমার বড়–য়া জানান, আমরা যথা সম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ইয়াবাসহ মাদক রোধে অভিযান পরিচালনা করে আসছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। মূল হোতাদের চিহ্নিতসহ গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইয়াবা আসক্তদের মধ্যে রয়েছে কিশোর তরুণ, স্কুল-কলেজ পড়–য়া তরুণরা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বা হতাশায় বেশি হারে ইয়াবা ও মাদকাসক্ত হচ্ছে। ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে অসচেতনতা এবং অশিক্ষার কারণে ইয়াবা আসক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। ঈদগাঁও ফরিদ আহমদ কলেজের প্রভাষক নাজিম উদ্দীন বলেন, ঈদগাঁওর প্রতিটি স্তরে মাদক মৃত্যু ছোবল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আগামী প্রজন্ম যাদের উপর এ দেশ গড়ার ভার তারাই যদি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তবে দেশের ভবিষ্যত তো অন্ধকার! কক্সবাজার সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুলতান আহমদ বলেন, প্রতিনিয়ত মাদকের করাল গ্রাসে থমকে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় একেকটি অধ্যায়। তাই ছাত্রসমাজকে ইয়াবা, মাদকাসক্তি থেকে বাঁচাতে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এক প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বৃহত্তর ঈদগাঁওতে কত ইয়াবা সেবি রয়েছে এর কোন সঠিক হিসাব নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে ৪ থেকে ৫ হাজার। কারো মতে এ সংখ্যা আরো বেশি। এর মধ্যে সরকারী-বেসরকারী, চাকরীজীবীসহ জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রেখেই অসৎ সঙ্গে এসব মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে তরুণরা। এতে শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের শিক্ষা জীবন। তথ্য মতে দেখা গেছে, ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী ইয়াবা সেবির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২৮.৩৭ শতাংশ, ১৯.৭৫ শতাংশ মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষা পাশ উচ্চ শিক্ষিতদের তুলনায় কম শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে মাদক ও ইয়াবা আসক্তির হার বেশি। ৮.৪৭ শতাংশ মাদকসেবি প্রথম মাদক গ্রহণ করেছে বন্ধুর প্রভাবে। বেশির ভাগ মাদকাসক্ত বেকার বা কর্মহীন জীবন কাটাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদক সেবির সংখ্যা বিপুল হারে বাড়ছে এমন উদ্বেগের কথা জানালেন সচেতন মহল। শুধু তাই নয়, অনেক শিক্ষার্থী মাদক পাচারেও ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক সময় পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করতে না পারায় পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় হওয়া, প্রেমঘটিত কারণসহ নানা কারণে শিক্ষার্থী মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে মনে করছেন অনেকে। কয়েক শিক্ষার্থীর অভিভাবক কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই মাদকের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতেই মাদক প্রতিরোধক কোন ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চান তারা। ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মোঃ খায়রুজ্জামান বলেন, এলাকায় কে বা কারা ইয়াবা মাদক বিক্রির সাথে জড়িত সঠিক কোন তথ্য নেই। তবে কেউ এসব মাদক ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের তথ্য দিতে পারলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবেন তিনি। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায়, বর্ণিত পাচার এলাকার লোকজন ইয়াবা পাচার সিন্ডিকেটের ভয়ে মুখ খুলতে রাজি নয়। তার পরেও অনেকেই বলেছেন, হঠাৎ গভীর রাতে মোটর সাইকেল, প্রাইভেট কার, বিলাসবহুল গাড়ীর আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। ধারণা এসব নামীদামী গাড়ীতে করে ইয়াবা চলে যায় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ইয়াবার মত মরণ নেশা থেকে যুব সমাজকে রক্ষাসহ জননিরাপত্তার স্বার্থে ঈদগাঁওর মাদক ও ইয়াবা ব্যবসায়ী গডফাদারদের গ্রেফতারের দাবী জানিয়েছেন বৃহত্তর ঈদগাঁওবাসী।